Introduction to Political Theory
প্রশ্নঃ আইন কী? আইনের উৎসসমূহ কী কী? অথবা, আইনের সংজ্ঞা দাও। আইনের উৎসগুলো আলোচনা কর।
ভূমিকা
আইন হলো সমাজে মানুষের চলাফেরার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য কিছু নিয়মকানুনের সমষ্টি। এটি এমন কিছু কঠোর বিধান বা রীতি যা সমাজের শৃঙ্খলা, ন্যায়বিচার, অর্থনীতি, এবং সামাজিক কাঠামো বজায় রাখতে ব্যবহৃত হয়। আইন লিখিত হতে পারে, তবে প্রচলিত বিধি-বিধান ও সামাজিক রীতিনীতিও আইন হিসেবে বিবেচিত হয়। তবে অলিখিত আইন মানার জন্য প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কাউকে বাধ্য করা যায় না, কিন্তু সামাজিক চাপ প্রয়োগ করা যেতে পারে।
আইন শব্দের উৎপত্তি
‘আইন’ হলো একটি ফারসি শব্দ যার আভিধানিক অর্থ হলো সরকারি বিধি, বিধান, কানুন বা নিয়মাবলি যা দেশের সমস্ত মানুষ মেনে চলে বা মানতে বাধ্য হয়। এই শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো “Law,” যা এসেছে ‘Lag’ নামক অন্য একটি শব্দ থেকে, যার অর্থ হলো স্থির ও অপরিবর্তনীয় যা সবার ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য।
আইন কী?
আইন হলো সেই নিয়ম বা বিধি যা সমাজে শৃঙ্খলা বজায় রাখে এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করে। আইন নাগরিকদের অধিকার ও কর্তব্য নির্ধারণ করে এবং সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য হয়। এটি একটি কাঠামো যা সমাজে বসবাসকারী মানুষের সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণ করে।
গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল বলেছেন, “পক্ষপাতহীন যুক্তিই হচ্ছে আইন।” আইনবিদ জন অস্টিনের মতে, “সার্বভৌম শক্তির আদেশই হলো আইন।” অধ্যাপক হল্যান্ড বলেছেন, “আইন হলো মানুষের বাহ্যিক আচরণ নিয়ন্ত্রণের এমন কতগুলো সাধারণ নিয়ম যা সার্বভৌম রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ দ্বারা প্রণীত হয়।”
Read More: রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে ঐতিহাসিক বা বিবর্তনমূলক মতবাদটি বর্ণনা কর
আইনের উৎসসমূহ
আইনের উৎসগুলো হলো সেই ভিত্তি যা থেকে আইন প্রণয়ন করা হয় এবং যার মাধ্যমে একটি সমাজে শৃঙ্খলা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা হয়। আইনের উৎসগুলো বিভিন্ন দিক থেকে বিবেচনা করা যায়, যেমন প্রথাগত, ধর্মীয়, বিচারকৃত সিদ্ধান্ত, আইনজ্ঞদের ভাষ্য, এবং রাষ্ট্রীয় আইনসভা। নিম্নে আইনের উৎসসমূহ বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:
১. চিরাচরিত প্রথা
চিরাচরিত প্রথা বা কাস্টম হল সেই সামাজিক রীতি বা নিয়ম যা দীর্ঘদিন ধরে কোনো সমাজে প্রচলিত। এই প্রথাগুলো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আইনে পরিণত হয়। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়, হিন্দু ব্যক্তিগত আইন এবং মুসলিম ব্যক্তিগত আইন যা ভারতের প্রথাগত প্রথার উপর ভিত্তি করে গঠিত। প্রথাগত আইন বিশেষত প্রাচীন সমাজে বিশাল প্রভাব ফেলেছে এবং এখনও অনেক দেশের আইনব্যবস্থায় এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
২. ধর্ম
ধর্মও আইনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়, বিশেষত প্রাচীন সমাজে। ধর্মীয় বিধান অনেক সময়ই আইনের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। ইসলাম ধর্মের শারিয়া আইন, হিন্দু ধর্মের ধর্মশাস্ত্র বা সন্ন্যাসীর অনুশাসন থেকে আইন প্রণীত হয়। প্রাচীন রোমান আইনের ভিত্তি ছিল ধর্মীয় নিয়মাবলি, যা পরবর্তীতে আইনের রূপ লাভ করে।
৩. বিচারকের রায়
বিচারকদের রায় বা বিচারিক দৃষ্টান্তও আইনের একটি প্রধান উৎস। বিচারকেরা যখন কোনো মামলার রায় প্রদান করেন, তখন সেই রায় অনেক সময় নতুন আইনের সৃষ্টি করে। বিশেষত উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্তগুলো নিম্ন আদালতগুলো অনুসরণ করে, যা এক ধরনের দৃষ্টান্তমূলক আইন হিসেবে গৃহীত হয়। উদাহরণস্বরূপ, ইংল্যান্ডের সাধারণ আইন (Common Law) যা বিচারকদের রায়ের ভিত্তিতে গঠিত।
৪. আইনজ্ঞগণের ভাষ্য
বিশিষ্ট আইনজ্ঞগণের বিজ্ঞানসম্মত আলোচনা এবং পর্যালোচনা আইনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস। তারা প্রাচীন ও বর্তমান তথ্যাদির তুলনামূলক আলোচনা করে আইনের ব্যাখ্যা ও স্বরূপ তুলে ধরেন। উদাহরণস্বরূপ, ইমাম আবু হানিফার মতবাদ এবং ইংল্যান্ডের ব্র্যাকস্টোনের রচনাগুলো আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
Read More: ’বর্তমানে সকল রাষ্ট্রের আইনসভার ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে’ – আলোচনা কর
৫. ন্যায়নীতি
ন্যায়নীতি (Equity) হলো সেই নৈতিক এবং ন্যায়সংগত ধারণা, যা আইনের প্রয়োগে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। যেখানে প্রচলিত আইন যথাযথ সমাধান দিতে ব্যর্থ হয়, সেখানে ন্যায়নীতি প্রয়োগ করা হয়। এটি সাধারণত সাম্য বা ন্যায়বিচারের উপর ভিত্তি করে থাকে এবং এর ভিত্তিতে অনেক নতুন আইন তৈরি হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ইংল্যান্ডের চ্যান্সারি কোর্টের মাধ্যমে ন্যায়নীতির আইন প্রতিষ্ঠিত হয়।
৬. আইন পরিষদ
আধুনিক কালে আইন পরিষদ (Legislature) বা আইনসভা আইনের সর্বপ্রধান এবং সর্বপ্রথম উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়। আইন পরিষদে আইন প্রণয়ন হয়, যেখানে জনমতের প্রতিফলন ঘটে। এটি গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আইন প্রণয়নের প্রধান উৎস। সংসদে পাসকৃত আইনসমূহ রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয় এবং তা সমাজের সকল সদস্যকে মানতে বাধ্য করা হয়।
৭. সংবিধান
সংবিধান হলো একটি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন এবং এটি একটি আনুষ্ঠানিক আইনের উৎস হিসেবে গৃহীত। সংবিধানে রাষ্ট্রের মৌলিক কাঠামো, নীতিমালা, এবং নাগরিকদের মৌলিক অধিকার ও কর্তব্য সন্নিবেশিত থাকে। সংবিধানকে কেন্দ্র করেই অন্যান্য আইনের সৃষ্টি হয় এবং তা প্রয়োগ করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশের সংবিধান দেশের সকল আইন এবং শাসন ব্যবস্থার মূল উৎস।
৮. আন্তর্জাতিক আইন
আন্তর্জাতিক আইন (International Law) হলো রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ধারণকারী আইন। এটি আন্তর্জাতিক সংগঠনসমূহের চুক্তি, সম্মেলন, এবং রীতি দ্বারা গঠিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, জাতিসংঘের সনদ, জেনেভা কনভেনশন, এবং মানবাধিকার সংক্রান্ত বিভিন্ন চুক্তি আন্তর্জাতিক আইনের অন্তর্গত।
৯. জনমত
জনমত (Public Opinion) আইনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়। সমাজের সাধারণ মানুষের মতামত আইন প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আইনসভা যখন কোনো আইন প্রণয়ন করে, তখন জনমতকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা হয়। জনমতের প্রতিফলন ঘটে আইনসভায় নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে, যারা জনগণের ইচ্ছা ও আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী আইন প্রণয়ন করেন।
১০. নির্বাহী ঘোষণা ও ডিক্রী
নির্বাহী বিভাগ কর্তৃক জারীকৃত ঘোষণা এবং ডিক্রী আইনের একটি উৎস হিসেবে কাজ করে। আধুনিক যুগে আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে নির্বাহী বিভাগের ভূমিকা বৃদ্ধি পেয়েছে, যেখানে বিভিন্ন প্রশাসনিক আদেশ এবং ঘোষণার মাধ্যমে আইন প্রণয়ন করা হয়। এসব আদেশ ও ডিক্রীকে প্রশাসনিক আইন হিসেবে গৃহীত হয়, যা সমাজে বাধ্যতামূলকভাবে পালনীয়।
১১. বিজ্ঞানসম্মত ভাষ্য
বিজ্ঞানসম্মত ভাষ্য বা বৈজ্ঞানিক মতবাদও আইনের একটি উৎস। বিশিষ্ট আইনবিদদের গবেষণা, পর্যালোচনা, এবং মতামত আইনের বিকাশে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। তাদের এই বৈজ্ঞানিক মতামত আদালত কর্তৃক গ্রহণ করা হয় এবং তা আইনের রূপ লাভ করে। উদাহরণস্বরূপ, অধ্যাপক ডাইসির ‘ল অব দ্যা কনস্টিটিউশন’ এবং ব্লাকস্টোনের ‘কমেনটরিজ অন দ্যা লজ অব ইংল্যান্ড’ আইন প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
১২. আইনবিদদের গ্রন্থ
বিচারকগণ কোনো মামলার বিচারকার্য সম্পাদন করতে গিয়ে যদি আইন সংক্রান্ত কোনো জটিলতায় পড়েন, তাহলে তারা তা সমাধানের জন্য আইনজ্ঞদের বিজ্ঞানসম্মত গ্রন্থের সাহায্য নেন। এসব গ্রন্থে বিচারকরা আইনের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ পেয়ে থাকেন, যা পরবর্তী সময়ে আইনে পরিণত হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ব্ল্যাকস্টোনের ‘কমেন্টারিজ অন দ্য লজ অব ইংল্যান্ড’ একটি প্রসিদ্ধ আইনগ্রন্থ যা আদালতে প্রায়শই রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
Read More: Introduction to Political Theory’s Questions and Answers
উপসংহার
আইনের বিভিন্ন উৎসের মধ্যে প্রথা বা রীতি-নীতি প্রাচীনতম উৎস হিসেবে পরিচিত। বিচারালয়ের সিদ্ধান্ত এবং আধুনিক কালে আইনজ্ঞদের বিজ্ঞানসম্মত আলোচনা ও আইনসভা আইনের গুরুত্বপূর্ণ উৎসে পরিণত হয়েছে। আইনের এই বিভিন্ন উৎসসমূহের মাধ্যমে সমাজে শৃঙ্খলা বজায় রাখা এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়।